পাকা ধানেও বিষ
লেদা পোকার আক্রমণে আধা-পাকা ধান কেটে ঘরে তুলছে কৃষক
‘দফায় দফায় জোয়ার আর দেওইর পানিতে বীচলাখলা তলাইয়া অনেক ক্ষতির অইচে। এ্যাহন ক্ষণিকাডা পোহের জ্বালায় অর্ধেক ধানও ঘরে আইবে না।’ সাড়ে ৩ কানি (৯৪০ শতাংশ) জমিন চাষ করছি। ধান যা অওয়ার কতা হ্যার দশ ভাগের এক ভাগও অইবে না!’
-এমন হতাশা ব্যাক্ত করে শীষ কাটা লেদা পোকায় আক্রান্ত ক্ষেতের ইরি-৫২ জাতের আধা-পাকা ধান কাটছিলেন ছত্তার ফকিরের ছেলে কৃষক মজিবর ফকির।
দফায় দফায় অতিবৃষ্টি, জোয়ারের পানি আর ঝড়োবাতাসে ক্ষয়-ক্ষতির পরে শীষকাটা লেদা পোকার আক্রমণে এবার আধা-পাকা ধান কেটে ঘরে তুলছেন পটুয়াখালীর বাউফলের ধুলিয়া ইউপির মঠবাড়িয়া গ্রামের এই কৃষক মজিবর।
কেবল মজিবরই নয়; ক্ষেতের ধান কাটার উপযুক্ত সময় আরো অন্তত ১৫-১৬ দিন সামনে থাকলেও শীষকাটা লেদা পোকার আক্রমন থেকে সামান্য রেহাই পেতে আগেভাগে আগাম জাতের আধা-পাকা ধান কেটে ঘরে তুলছেন একই গ্রামের সেলিম ফকির, জাহাঙ্গির খা, নিজাম খা, জসিম খাসহ অনেক কৃষক। পোকার আক্রমণ ঠেকাতে কেউ কেউ আবার ক্ষেতের পাকা ধানেও ছিটাচ্ছেন বিষ।
মাঠে মাঠে আমন ধানের ক্ষেতে চোখ জুড়ানো সোনালী-হলুদাভাব আসতে শুরু করেছে মাত্র। কিন্তু অতিবৃষ্টি, জোয়ারের পানি আর ঝড়োবাতাসে ক্ষয়-ক্ষতির পরে এবার শীষকাটা লেদা পোকার আক্রমনে কীটনাশকেও ভালো ফল না পাওয়ায় দিশেহারা হয়ে কিছুটা হলেও ক্ষতির পরিমাণ কমাতে ক্ষেতের আধা-পাকা ধান কাটতেই ব্যস্ত হয়েছেন অনেক কৃষক।
সুলতানাবাদ গ্রামের ইউনুস মৃধা, ধানদী গ্রামের আহেদ রাঢ়ী, আলতু রাঢ়ী, বড়ডালিমা গ্রামের জাহাঙ্গির মৃধা, তালতলী গ্রামের ছোবহান হাওলাদার, ভরিপাশা গ্রামের সেলিম গাজীসহ অনেক কৃষক-কৃষাণী সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তেঁতুলিয়া নদী পাড়ের কেবল মঠবাড়িয়া কিংবা ঘুচরকাঠিই নয় উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে ও বিচ্ছিন্ন চরাঞ্চলে শীষকাটা লেদা পোকার আক্রমণের কথা।
ক্ষেতের আধা-পাকা ধান কাটার কারণ হিসেবে মজিবর ফকির জানান, ‘পচিশোর্ধ সময় কাল থেকে চাষবাসে জড়িত তিনি। সংসারের অভারের তাড়নায় লেখাপড়া ভাগ্যে না জোটায় বাপদাদার পেশা কৃষিকাজে জড়িয়ে পড়েন তিনি। নিজে লেখাপড়া করতে পারেননি কেবল সেই দুঃখ ভুলতেই চাষবাসের এই কাজে নিজেকে জড়িয়ে রেখেও বড় ছেলে রবিউলকে এসএসসি পাশ করিয়েছেন।
দ্বিতীয় ছেলে আউয়াল হোসেন স্থানীয় কমলাপুর এনএস মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণিতে ও ছোটে মেয়ে আফরোজাকে পড়ছে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে। তবে কৃষি কাজের আয়ে এখন ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার খবরচসহ ভালভাবে পাঁচজনের সংসার চলে না তার। কাজে আছে নানা বিপর্যয়। বাজার দরও ঠিক ঠাক মিলে না।
এক পর্যায়ে ধান গাছের গোড়ার দিকে লুকানো বেশ কয়েকটি লেদা পোকা তুলে হাতে নিয়ে দেখিয়ে বলেন, ‘গত বছরের মতো ধানকাডা এই পোকাগুলায় এবারও সর্বনাশ করছে। এন্ডিনেও মরে না। সিডিয়াল, ওস্তাদসহ আরো ওষুধ অন্তত পাঁচ বার কইরগ্যা ছিডাইছি। কোম কাম করেনা ওষুধে।’
ঘুচরাকাঠি গ্রামের ছোবহান হাওলাদারের ছেলে কৃষক বশার হাওলাদার জানান, ক্ষনিকাটা (শীষ কাটা) লেদা পোকার আক্রমমে তার চাষের স্থানীয় মাপের প্রায় তিন কানি জমির মোতামোটা, ইরি-৫২, স্বাক্ষর খোড়া জাতের ধান বিনস্ট হয়েছে। একই ধরণের পোকার আক্রমন স্থানীয় মাপের ২ কানি পরিমান জমির ধানে কাচি ফেলতে পারবেন না মঠবাড়িয়ার জাহাঙ্গীর খা। অপরদিকে লেদা পোকার আক্রমণ থেকে ক্ষেতের ধান রক্ষায় সুলতানাবাদ গ্রামের কৃষক হারুন অর রশিদ দেওয়ানকে দেখা যায় সোনালী রঙের প্রায় পাকা ধানেও বিষ (সেমকোর কাপ ৫০ ইসি বালাইনাশক) ছিটাতে।
এবার আমন মৌসুমের শুরুতেই ধানের বাজার দর মনপ্রতি ৮শ’ থেকে ৯শ’ টাকা উল্লেখ করে ধানদী গ্রামের কৃষক রহিম মৃধা বলেন, ‘ধানের বাজার দর ভালো অইলে কি আর না অইলেওই বা কি। এবার প্রায় দেড় একর জমির ধানই নষ্ট হইয়া গেছে কেবল পোকার আক্রমণে।’ এদিকে পোকার আক্রমণে একর খানেক জমির ধানের শীষই বের হয়নি মোহাম্মদ আলী নামে একই গ্রামের অপর এক কৃষকের।
তিনি বলেন, ‘বাজারের ওষুধেও কোন কাজ করে নাই। এবার বৃষ্টিপাতের কারণে সঠিক সময়ে শুকাতে পারেনি ধান ক্ষেত। স্যাতস্যাতে ভাব এখনও ক্ষেতে। দিনের বেলায় লেদা পোকা ধানের গোছার গোড়ায় লুকিয়ে থাকে আর রাতে শীষ কাটে। ধান খায় না। তবে শীষ ও শীষের কানা কেটে ধান ঝড়িয়ে সর্বনাশ করছে এরা। গত বছর আর এই চলতি মৌসুমের মতো ১৫-২০ বছরেও লেদা পোকার এমন মারাত্মক আক্রমণ চোখে পড়ে নি। আধা-পাকা ধানের ক্ষেতে ঝড়া ধান ছড়িয়ে আছে।’
বৈশ্বিক আবহাওয়া পরিবর্তণের ইঙ্গিত করে পোকার আক্রমণের হাত থেকে ধানের ফলন বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে আবহাওয়া অধিদপ্তরের দায়িত্বশীল ভূমিকা এবং কৃষি অধিদপ্তরের বেশি বেশি কর্মশালা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে পোকা দমন ও চাসবাসে কৃষক-কৃষাণীর সচেতনতা সৃষ্টির তাগিদ দিয়ে পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্লান্ট ফাইটোলোজির এসোসিয়েট প্রফেসর ড. শাহ মো. আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘অতি বৃষ্টিপাতের মতো আবহায়ার বিরূপ প্রভাব, রোদ, তাপমাত্রা, শীত, গাছের শক্তিমত্তা এসব কারণে বংশবৃদ্ধি ঘটে পোকার আক্রমন হতে পারে। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে পোকা দমন ও চাসবাসে কৃষক-কৃষাণীর সচেতনতা সৃষ্টি খুবই জরুরি হয়েছে।’
একই বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যানটোমোলোজির প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আতিকুর রহমান বলেন, ‘আমাদের দক্ষিণাঞ্চলে এ ধরণের অবস্থা প্রায়ই হয়ে থাকে। ১০-১২ বছর আগে একবার পাতা মোড়ানো রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা গিয়েছিল। গত তিন বছর আগে একবার কারেন্ট পোকা বা ধানের বাদামি পোকার আক্রমণ হয়। লেদা পোকার আক্রমণের কথা গত বছরেও জানা গেছে।
পরিমিত মাত্রায় বৃষ্টিপাত না হওয়া, তাপমাত্রা কিংবা গাছ থেকে গাছের দূরত্বের কারণে পাতার সংখ্যা বেড়ে গিয়ে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়ে ধানের শীষকাটা লেদা পোকার আক্রমণ হতে পারে। শীষ যখন বের হয়ে আসে তখন শীষ কাটা এই লেদা পোকা আক্রমণ করে। এই মথগুলো এক একটি ২০০-৩০০ ডিম দেয়। আর মাত্র একজোড়া মথই একটি ফসলের জমি ধ্বংস করতে যথেষ্ট। প্রাথমিক স্টেজে সচেতন থেকে কৃষদের উচিত এই মথগুলো মেরে ফেলা বা কন্ট্রোলে নিয়ে আসা। কৃষি বিভাগেরও উচিত এই শীষ কাটা মথটিকে কৃষকদের চিনিয়ে দিয়ে সচেতন করা। রাতে এগুলো সক্রিয় থাকে।
সহজে ও কম খরচে আলোর ফাঁদ, আক্রান্ত জমিতে গর্তকরে পাতা জমিয়ে রেখে সেখানে এগুলোকে আশ্রয় নিতে দিয়ে, পাকা শুরু হওয়ার আগে কেরশিনে ভিজিয়ে ধানের ওপর রশি টেনে দিয়ে ও আক্রান্ত ক্ষেতের অংশের চারপাশে ছাঁই ছিটিয়ে দিয়ে পোকাগুলো মেরে ও নিয়ন্ত্রণ করা। একই জমিতে বারবার একই ফসল ফলানো হলে ফসল তুলে নিয়ে গাছের গোড়াগুলো পুড়িয়ে জৈব সার হিসেবে জমিতে মিশিয়ে দেওয়া উচিত। কৃষি অফিসের উচিৎ কৃষকদের আবহাওয়ার সতর্কবার্তা দেওয়া ও লিফলেট বিতরণের মতো কাজের মাধ্যমে কৃষকদের সতর্ক করা।’
উপজেলায় প্রায় ৩৭ হাজার হেক্টর জমি আমন চাষের আওতায় এসেছে উল্লেখ করে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. মনিরুজ্জামান বলেন, ‘কৃষি অফিসের আমাদের লোকজন লিফলেট বিতরণসহ মাঠে কৃষকদের সচেতন করে নিয়মিত প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে। সার্বক্ষনিক ক্ষেতের অবস্থা জানানোর জন্য কৃষকদেরকেও অনুরোধ করা হচ্ছে। উপজেলায় এ বছর সরকারি ভাবে কৃষকদের কাছ থেকে ৭৩৫ মেট্রিকটন ধান ক্রয়ের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এতে কৃষকরা কিছুটা হলেও ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারবেন।