ইসলামি জ্ঞানচর্চায় নারী মনীষা
সহিহ বুখারির প্রথম দরস দিয়েছেন যে নারী মুহাদ্দিস
হাদিস শাস্ত্রে যেসব নারী মুহাদ্দিস অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন, যাদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও সাধনার বিনিময়ে মুসলিম জাতি নির্ভুল হাদিসগুলো পেয়ে সত্যের সন্ধান লাভ করতে পেরেছে-হজরত কারিমা আল মারওয়াযিয়্যা (রহ.) তাদের মধ্যে অন্যতম।
তার পুরো নাম কারিমা বিনতে আহমদ বিন মুহাম্মদ বিন হাতেম আল মারওয়াযিয়্যা (রহ.)। তিনি সহিহ বুখারির দরস প্রদানকারী সর্বপ্রথম নারী মুহাদ্দিস।
নবিজি (সা.)-এর সৌরভমাখা মুখনিঃসৃত হাদিস সংকলন ও সংরক্ষণের মহান দায়িত্ব পালনে উৎসর্গিতপ্রাণ একজন কীর্তিমান নারী।
৩৬৫ হিজরির কোনো এক রহমঝরা প্রহরে খোরাসানের মার্ভ শহরে তার জন্ম। তিনি মৃত্যুবরণ করেন ৪৬৩ হিজরির এক শুভক্ষণে।
হায়াত পান ৯৮ বছর। প্রায় শতবসন্তের দীর্ঘ এ জীবনের পুরোটাই তিনি বিসর্জন দিয়েছেন ইলমের জন্য। হাদিসের জন্য।
রাসূলে কারিম (সা.)-এর পবিত্র হাদিস পাঠদানের সৌভাগ্যময় কর্মব্যস্ততায় বিয়ের পিঁড়িতে বসার ফুরসতটুকুও পাননি তিনি।
আজনম থেকেছেন কুমারী। চিরকুমারী। হাদিসের জন্য জীবনব্যাপী তার এ ত্যাগ-তিতিক্ষা ও সাধনার ফলেই ইতিহাসবেত্তারা তাকে ভূষিত করেছেন ‘উম্মুল কিরাম’ তথা সম্মানিতদের মা উপাধিতে।
পিতার কাছে তার লেখাপড়ার হাতেখড়ি হলেও তিনি হাদিসের দরস গ্রহণ করেছেন যুগশ্রেষ্ঠ ও জগদ্বিখ্যাত অনেক মুহাদ্দিস থেকে।
হজরত আবু হাইসাম মুহাম্মাদ বিন মাক্কি আল কুশমিহানি (৩৮৯ হি.) (রহ.)-এর মতো পৃথিবীখ্যাত মুহাদ্দিসের সান্নিধ্য-সৌরভ লাভ করেছেন তিনি। ধন্য হয়েছেন তার হাদিসের বিশুদ্ধ গ্রন্থ সহিহ বুখারির মোবারক দরসে বসে।
শুধু হাদিস নয়; ফিকাহ শাস্ত্রেও তার ব্যাপক পড়াশোনা ছিল। ইতিহাস-শ্রেষ্ঠ অনেক ফিকাহবিদ থেকে তিনি গ্রহণ করেছেন ফিকহের পাঠ।
তার ফিকহের উস্তাদগণের মধ্যে অন্যতম হলেন হজরত যাহের বিন আহমদ আস সারাখসি আশ শাফেয়ী (৩৮৯হি.) (রহ.) ও হজরত আব্দুল্লাহ বিন ইউসুফ ইস্পাহানি (৪০৯হি.) (রহ.)।
মহীয়সী এ নারী ইলমের পিপাসায় ছিলেন পিপাসিত। হাদিসের তৃষ্ণায় ছিলেন তৃষ্ণাতুর। শুধু ঘরে বসে নয়; ইলমের জন্য স্বীয় পিতা আহমাদ বিন মুহাম্মাদের সঙ্গে অতিক্রম করেছেন বহু পথ।
পাড়ি দিয়েছেন ধু-ধু মরুপ্রান্তর। গিয়েছেন বাইতুল মাকদিসে। ছুটেছেন খোরাসান, বাগদাদ ও সারাখসে।
অবশেষে মক্কায় এসে যখন আশ্রয় গড়েন তখনও বছরজুড়ে জিলহজ মাসের প্রতীক্ষায় প্রহর গুনতেন তিনি। হজের মৌসুমে পৃথিবীর কোনো এক প্রান্ত থেকে কোনো একজন মুহাদ্দিস উপস্থিত হয়েছেন জানতে পারলে ছুটে যেতেন তার দরবারে।
অজানা হাদিস জানার তীব্র আকাঙ্ক্ষায় ব্যাকুল হয়ে উঠতেন এ হাদিসপ্রেমী।
এভাবে পাঁচটি, দশটি অথবা একশটি নয়; সনদ ও মতনসহ লক্ষাধিক হাদিস মুখস্থ করেছিলেন ইতিহাসের কালজয়ী মহান এ নারী।
আমরা বিভিন্ন জরুরি বিষয় ফোন-ম্যামোরি অথবা কম্পিউটারের হার্ডিক্সে সংরক্ষণ করি। কিন্তু তিনি উম্মাহর জন্য নিজের স্মৃতিপটকেই বানিয়ে ফেলেছেন ব্যাপক ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন ম্যামোরি বা হার্ডিক্স। আর স্মৃতির আয়নাঘরে সযত্নে হেফাজত করেছেন অযুত-নিযুত হাদিস। হাদিসের রত্মভাণ্ডার।
মসজিদে হারাম ছিল হজরত কারিমা আল মারওয়াযিয়্যা (রহ.)-এর দরসগাহ। কাবা ঘরের দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসতেন তিনি।
অনর্গল বর্ণনা করতেন হাদিসের শব্দ-ছন্দ। দূরদূরান্ত থেকে ছুটে আসা শত-সহস্র হাদিসের শিক্ষার্থীরা তার ইলমে হাদিসের অফুরন্ত ফোয়ারা হতে আঁজলাভরে পান করত হাদিসের অমৃত সুধা।
হাদিস শাস্ত্রে ব্যাপক পাণ্ডিত্য ও বুৎপত্তি অর্জন করা এ নারী মুহাদ্দিসের প্রতিটি হাদিসের দরস ছিল বড় শানদার। জাঁকজমকপূর্ণ।
বরকতময়। হাদিস বর্ণনার ক্ষেত্রে সনদের প্রতি তিনি খুব খেয়াল রাখতেন। এ কারণেই তো দেশ দেশান্তর হতে যামানার বড় বড় মুহাদ্দিস পর্যন্ত ছুটে আসতেন তার দরসে। ব্যাকুল হয়ে অপেক্ষায় প্রহর গুনতেন শুধু তার মুখ থেকে একটি হাদিস শোনার জন্য।
আলি বিন হুসাইন আল ফাররা, খতিব আবু বকর আল বাগদাদী, আবুল গনাঈম নারসি, আবু তালিব হুসাইন বিন মুহাম্মদ জাইনাবি, মুহাম্মদ বিন বারাকাত সাঈদি, আব্দুল্লাহ বিন মুহাম্মদ বিন সদাকাহ ও আলি বিন ইবরাহীম আন নাসিবের মতো যামানার শত-সহস্র মুহাদ্দিস ছিলেন তার দরসে হাদিসের মুগ্ধ শ্রোতা। বিমুগ্ধ শিক্ষার্থী।
অসম্ভব বুদ্ধিমত্তা ও প্রখর ধীশক্তিসম্পন্ন এ মহীয়সী নারী শুধু হাদিসের পাঠদানেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না; লিখনীর মাধ্যমেও আঞ্জাম দিয়েছেন বিরাট বিরাট খেদমত। পৃথিবীর সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য হাদিসগ্রন্থ ‘সহিহুল বুখারি’ তিনি এ সহিহ বুখারির ৪৫ খণ্ডের এক বিশাল ব্যাখ্যাগ্রন্থ সংকলন করেন।
যেটি সহিহ বুখারির নির্ভরযোগ্য অন্যান্য ব্যাখ্যাগ্রন্থের মধ্যে অন্যতম, শ্রেষ্ঠ। যে ব্যাখ্যাগ্রন্থটির ভূয়সী প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন হাদিস শাস্ত্রের আরেক বরেণ্য মুহাদ্দিস আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানি (রহ.)।
৪৬৩ হিজরির এক প্রভাতবেলায় ইরানের হামাদান প্রদেশ থেকে ঘোড়া হাঁকান ইরানের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস হজরত আবু জাফর মুহাম্মাদ বিন আলি আল হামদানি।
গন্তব্য মক্কাতুল মুকাররমা। উদ্দেশ্য হজরত কারিমা আল মারওয়াযিয়্যার হাদিসের দরসে বসা এবং সহিহ বুখারির সর্বোচ্চ মানের সনদ গ্রহণ করা।
কারণ, হজরত কারিমা আল মারওয়াযিয়্যার বুখারির সনদ ছিল সর্বোচ্চ মানের সনদ।
তৎকালীন শায়েখ হজরত আবু জর (রহ.) সব ত্বলাবাদের উপদেশ দিয়ে বলতেন, ‘তোমরা কেউ যেন কারিমা আল মারওয়াযিয়্যা ব্যতীত অন্য কারো কাছ থেকে সহীহ বুখারি অধ্যয়ন না কর।’
যোজন যোজন পথ পেরিয়ে, পাথুরে পাহাড় মাড়িয়ে আবু জাফর মুহাম্মাদ বিন আলি আল হামদানি পৌঁছেন মক্কায়। মসজিদে হারামে।
কিন্তু বড় আফসোস এবং কষ্টের বিষয় হলো তিনি মসজিদে হারামে পৌঁছার পূর্বে, ওই দিনই দুনিয়া ছেড়ে অনন্তের পথে যাত্রা করেন পঞ্চম শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ নারী মুহাদ্দিস হজরত কারিমা আল মারওয়াযিয়্যাহ। রহিমাহাল্লাহু আযযা ওয়া জাল্লা।
হজরত কারিমা আল মারওয়াযিয়্যার মতো হাদিসের নারী মহারথী আরব্য ইতিহাস কেন; গোটা পৃথিবীই খুব কম দেখেছে। উম্মাহর কাছে রাসূলের হাদিস পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে তার যে সাধনা ও অধ্যাবসায়, ত্যাগ ও তিতিক্ষা পৃথিবীবাসী তা কোনোদিনও ভুলতে পারবে না। ভুলতে পারবে না তার অবদান ও অমরকীর্তি।
রাব্বে কারিম তার প্রতি রহম করুন, তার কবরকে নূরে নূরান্বিত করুন এবং জান্নাতি সৌরভে সুরভিত করুন। আমিন, ইয়া রাব্বুল আলামিন।