একাত্তরের বুদ্ধিজীবী-হ’ত্যার তদন্ত চাই,ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ
ব্যারিস্টার ড. তুরিন আফরোজ: বাংলাদেশে প্রতিবছর ১৪ ডিসেম্বর দিনটিকে শ’হীদ বুদ্ধিজীবী দিবস হিসেবে পালন করা হয়। এটি আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের করুণ ইতিহাসের একটি অংশ।
তবে আমাদের মনে রাখতে হবে, ১৯৭১ সালে বছরব্যাপী পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং তাদের এদেশীয় দোসররা বাঙালি বু’দ্ধিজীবীদের নির্মমভাবে হ’ত্যা করেছে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের অপারেশন সার্চ লাইট থেকে শুরু করে ডিসেম্বরের ১৬ তারিখ পর্যন্ত পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের অন্যতম লক্ষ্য ছিল
বাংলাদেশকে মেধাশূন্য করে দেবার। তবে পরিকল্পিতভাবে ১৯৭১ সালের ১০ থেকে ১৪ ডিসেম্বরে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক বু’দ্ধিজীবীকে হ’ত্যা করা হয়েছিল।
আর তাই বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী বঙ্গতাজ তাজউদ্দীন আহমদ ১৪ ডিসেম্বর দিনটিকে ‘শ’হীদ বুদ্ধিজীবী দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেন।
বু’দ্ধিজীবী হ’ত্যা নব্যসৃষ্ট বাংলাদেশের ভিত নড়িয়ে দেয়। মহান মুক্তিযুদ্ধে ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ অপরিসীম। ৩০ লাখ শ’হীদের তাজা রক্ত তখনো বাংলার মাটিতে দগদগে।
কিন্তু নতুন একটি দেশ গঠনের জন্য চাই মেধা এবং দূরদৃষ্টি, যার জন্য খুব বেশি প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল বু’দ্ধিজীবী সমাজের।
কিন্তু পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আর তাদের এদেশীয় দোসররা ঠিক এই জায়গাটিতে বসিয়ে রেখে গিয়েছিল ম’রণ কামড়।
বাঙালি জাতির মেরুদণ্ডে আঘাত দিয়ে আমাদের নেতৃত্বশূন্য করে দিয়েছিল। আমরা যে এই সত্যটি অনুভব করতে পারিনি তা কিন্তু নয়।
১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে বেসরকারিভাবে গঠন করা হয়, ‘বু’দ্ধিজীবী নিধন তদন্ত কমিশন’। এরপর ‘বু’দ্ধিজীবী তদন্ত কমিটি’ গঠন করা হয়। ‘বু’দ্ধিজীবী তদন্ত কমিটি’র প্রধান করা হয় প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার, পরিচালক, উপন্যাসিক এবং গল্পকার জহির রায়হানকে।
বুদ্ধিজীবী তদন্ত কমিটির প্রধান জহির রায়হান এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘(এরা) নির্ভুলভাবে বাংলাদেশের গণতন্ত্রমনষ্ক বু’দ্ধিজীবীদের বাছাই করে আ’ঘাত হেনেছে’।
এখানে উল্লেখ্য যে, ‘বুদ্ধিজীবী তদন্ত কমিটি’র প্রাথমিক রিপোর্টে বলা হয়, রাও ফরমান আলী এদেশের ২০,০০০ বুদ্ধিজীবীকে হ’ত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন।
কিন্তু এই পরিকল্পনা মতো হ’ত্যাযজ্ঞ চলেনি। কারণ ফরমান আলীর লক্ষ্য ছিল শীর্ষ বুদ্ধিজীবীদের গভর্নর হাউজে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে গিয়ে হ’ত্যা করা।
এখানে উল্লেখ্য যে, বঙ্গতাজ তাজউদ্দীন আহমদ বুদ্ধিজীবী নিধন বিষয়ে সরকারি ভাবে একটি তদন্ত কমিশন গঠনের সিদ্ধান্ত নেন ১৯৭১ সালের ৩১ ডিসেম্বর। কিন্তু তার ওই সিদ্ধান্ত কোন এক অজ্ঞাত কারণে কার্যকর হয়নি।
এদিকে ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি জহির রায়হান নিখোঁজ হন। থমকে যায় বুদ্ধিজীবী হ’ত্যার বেসরকারি তদন্ত কাজটিও।
আর তাই, ‘বুদ্ধিজীবী তদন্ত কমিটি’র চূড়ান্ত রিপোর্ট আর দালিলিক অন্যান্য প্রমাণ সময়ের ধারাবাহিকতায় অন্তরালেই থেকে যায়।
১৯৭১ সালের ২৭ ডিসেম্বর দৈনিক আজাদের একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের হ’ত্যার পরিকল্পনাটি পূর্বেই করা হয় আর এতে সহায়তা করে জামায়াতে ইসলামী ও এর ছাত্র সংগঠন ছাত্রসংঘ।
এ হ”ত্যা’কাণ্ডে সবচেয়ে সক্রিয় ছিলেন ব্রি. জে. আসলাম, ক্যাপ্টেন তারেক, কর্ণেল তাজ, কর্ণেল তাহের, ভিসি প্রফেসর ডঃ সৈয়দ সাজ্জাদ হোসইন, ডঃ মোহর আলী, আল বদরের এবিএম খালেক মজুমদার, আশরাফুজ্জামান ও চৌধুরী মাইনুদ্দিন এবং এদের নেতৃত্ব দেয় মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী।
১৯৯৭ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর বুদ্ধিজীবী হ”ত্যার ঘটনায় রমনা থানায় প্রথম মা’মলা দায়ের করা হয় (মা’মলা নম্বর ১৫)। সেখানে আলবদর বাহিনীর চৌধুরী মাইনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামানকে আসামি করা হয়।
মা’মলাটি দায়ের করেন অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিনের বোন ফরিদা বানু। কিন্তু মা’মলাটি রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে নিষ্পত্তির দিকে এগোয়নি।
এছাড়া অন্তরালে থেকে যায় বুদ্ধিজীবী হ’ত্যার পরিকল্পনাকারীরা, যেমন নাকি, মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ প্রমুখ জামায়াতে ইসলামী ও এর ছাত্র সংগঠন ছাত্রসংঘের নেতৃবর্গ।
যু’দ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিভিন্ন মা’মলার নথিতে যে সকল দালিলিক তথ্য-প্রমাণ উঠে আসে তাতে প্রতীয়মান হয় যে, ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশে স্বাধীনতা যু’দ্ধের চূড়ান্ত বিজয়ের প্রাক্কালে পাকিস্তানি
সেনাবাহিনী ও তাদের সাথে রা’জাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনী বাংলাদেশের অসংখ্য শিক্ষাবিদ, গবেষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, সাংবাদিক, কবি ও সাহিত্যিকদের চোখ বেঁধে নিজ নিজ বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে তাদের নির্যাতনের পর হ’ত্যা করে।
চূড়ান্ত বিজয়ের প্রাক্কালে থাকায় স্বাধীন বাংলাদেশকে মেধাশূন্য করতে পরিকল্পিতভাবে এ হ’ত্যাযজ্ঞ সংগঠিত হয়। পরবর্তী সময়ে ঢাকার মিরপুর, রায়েরবাজার-সহ বিভিন্ন স্থানে গ’ণক’বরে তাদের মৃ’তদেহ পাওয়া যায়। ১৬ ডিসেম্বর মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর নিকট আত্মীয়রা মিরপুর ও রাজারবাগ বধ্যভূমিতে স্বজনের মৃ’তদেহ শনাক্ত করেন।
অনেকের দেহে আঘাতের চিহ্ন, চোখ, হাত-পা বাঁধা, কারও কারও শরীরে একাধিক গু’লি, অনেককে হ’ত্যা করা হয়েছিল ধারালো অ’স্ত্র দিয়ে জ’বাই করে। এর থেকে হ’ত্যার পূর্বে বুদ্ধিজীবীদের নির্মমভাবে নি’র্যাতন করা হয়েছিল তার প্রমাণ মেলে।
যু’দ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচ্ছিন্নভাবে বেশ কয়েক জন বুদ্ধিজীবী হ’ত্যাকাণ্ডের জন্য আশরাফুজ্জামান ও চৌধুরী মাইনুদ্দিনের মা’মলাতে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়। অভিযোগ পত্রটিতে সেই অর্থে বুদ্ধিজীবী হ’ত্যার ব্যাপকতা ফুটে ওঠেনি।
ঠিক একই ঘটনা ঘটে, মতিউর রহমান নিজামী এবং আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদের বি’রুদ্ধে করা মা’মলা দুটিতে। যু”দ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে একজন প্রসিকিঊটর হিসেবে আমার যোগ দানের পর (২০১৩ সালের ২০ ফেব্রূয়ারী) উল্লিখিত মা’মলা সমূহের দলিল পর্যবেক্ষণে আমার চোখে এই ঘাটতি খুব প্রকটভাবে চোখে পড়ে। কিন্তু তখন প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে নতুন করে অভিযোগ পত্র দাখিলের সময় পেরিয়ে গেছে।
মাননীয় ট্রাইব্যুনালও বেশ কয়েকবার তাদের অসন্তোষের কথা প্রকাশ্য আদালতে বলেছেন।
সাক্ষীর জবানবন্দী-জেরা শেষ করে আমি যখন আশরাফুজ্জামান ও চৌধুরী মাইনুদ্দিনের মা’মলাতে মাননীয় ট্রাইব্যুনালের বিশেষ নির্দেশে আইনী যুক্তি-তর্ক উপস্থাপন করি তখন একাত্তরের বুদ্ধিজীবী হ’ত্যার ব্যাপক চিত্রটি তুলে ধরি নানা দালিলিক প্রমাণাদির মাধ্যমে। ফলে বিচ্ছিন্নভাবে উপস্থাপিত বেশ কয়েকজন বুদ্ধিজীবী হ”ত্যাকাণ্ডের জন্য আশরাফুজ্জামান ও চৌধুরী মাইনুদ্দিনের বিরুদ্ধে হ’ত্যার অভিযোগ প্রমাণিত হলেও বুদ্ধিজীবী হ’ত্যার ব্যাপক চিত্রটি মা’মলার রায়ে স্থান করে নেয়।
এটিকে আমি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শ লালনকারীদের বিজয় বলেই মনে করি। আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ এবং মতিউর রহমান নিজামীর মা’মলাতে তখন আমার আইনী যুক্তিতর্ক উপস্থাপন সহজ হয়ে যায়। কারণ ইতিমধ্যে আশরাফুজ্জামান ও চৌধুরী মাইনুদ্দিনের মা’মলাতে বুদ্ধিজীবী হ’ত্যার ব্যাপক চিত্রটি মা’মলার রায়ে স্থান করে নিয়েছে।
আমার মাথায় ঘুরছিল শুধু সুপিরিয়র রেস্পন্সিবিলিটি আর্গুমেন্ট। কারণ আশরাফুজ্জামান ও চৌধুরী মাইনুদ্দিনের নেতা ছিলেন আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ এবং মতিউর রহমান নিজামী। সুতরাং যদি সুপিরিয়র রেস্পন্সিবিলিটি আর্গুমেন্ট মাননীয় ট্রাইব্যুনাল গ্রহণ করে তবে আমি শতভাগ নিশ্চিত ছিলাম যে সর্বোচ্চ শাস্তি আসতে বাধ্য।
শেষ পর্যন্ত অবশ্য তা-ই হলো। এই চারজনকেই মাননীয় ট্রাইব্যুনাল মৃ’ত্যুদ’ণ্ডে দণ্ডিত করলেন। তবে একজন মুক্তিযুদ্ধ-গবেষক এবং রাজপথের সৈনিক হিসেবে আমার এখনও অতৃপ্তি থেকে গেছে।
আমরা হয়তো জাতি হিসেবে আমাদের বুদ্ধিজীবীদের হ’ত্যার জন্য কয়েকজনকে মৃ’ত্যুদণ্ড দিতে পেরেছি। কিন্তু বুদ্ধিজীবী হ’ত্যার সকল ষ’ড়যন্ত্রকারীদের মুখোশ এখনো উন্মোচিত করতে পারিনি। আবার যাদের মুখোশ উন্মোচিত হয়েছে, তারা মৃ’ত্যুবরণ করায় তাদের মরণোত্তর বিচার করতে পারিনি।
আজ তাই খুব প্রয়োজন একাত্তরের বুদ্ধিজীবী-হ’ত্যার পূর্ণ তদন্ত। জাতি আর কতোদিন এই তদন্তের জন্য চুপ করে থাকবে? ইতিহাসের ঋণ শোধ করবে না? ন্যায়সঙ্গত দাবি জানাবে না? জানাবে!
সূত্র আমাদের সময়